IQNA

গাদির দিবস: হযরত আলীকে রাসূল (সা. আ)'র স্থলাভিষিক্ত ঘোষণার দিন

21:30 - August 19, 2019
সংবাদ: 2609105
আজ ঐতিহাসিক গাদির দিবস। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানসহ সারা বিশ্বের নানা অঞ্চলে পালিত হচ্ছে এই বিশেষ ঈদ উৎসব। প্রায় ১৪২৭ বছর আগের কথা। দশম হিজরির ১৮ ই জিলহজ বিদায় হজ শেষে সুরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াত নাজেল হওয়ার পর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর চাচাতো ভাই ও জামাতা আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)-কে ‘গাদীর’ নামক স্থানে নিজের উত্তরসূরি বা স্থলাভিষিক্ত বলে ঘোষণা করেছিলেন।

এই দিনটি ঐতিহাসিক গাদির দিবস বা ঈদে গাদির হিসেবে খ্যাত। আজ সেই ঈদে গাদীর উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি ঈদ মুবারক।

সুরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন: "হে রসূল, পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌঁছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।"

গাদিরের ওই সমাবেশে এক লাখ বিশ হাজারেরও বেশি সাহাবি ও হজযাত্রী উপস্থিত ছিলেন।

'জুহফা' নামক এলাকার কাছে 'গাদিরে খুম' জলাশয়ের পাশে বিশ্বনবী (সা.) ঘোষণা করেছিলেন যে, "মান কুনতু মাওলা ফাহাজা আলিয়ুন মাওলা" অর্থাৎ আমি যাদের মাওলা আলীও তাদের মাওলা বা নেতা।

ইমাম বোখারীসহ ৩৬০ জন সুন্নি মনীষী এ সংক্রান্ত হাদিস বর্ণনা করেছেন। এই হাদিসটির সনদ ১১০ সাহাবি কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে এবং ২৬ জন মুসলিম মনীষী এর সনদ ও পন্থা সম্পর্কে আলাদা বই রচনা করেছেন।

বিশ্বনবী (সা.) নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে আলী (আ.)'র মাথায় নিজের হাতে তাঁর একটি পবিত্র পাগড়ী পরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি গাদিরে খুমে তিন দিন অবস্থান করেছিলেন। এই তিন দিন ধরে শীর্ষস্থানীয় সব সাহাবিগণসহ সব মুসলিম নারী-পুরুষ পৃথকভাবে হযরত আলী (আ.)-কে আমিরুল মুমিনিন হিসেবে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন বলে নির্ভরযোগ্য সুন্নি বর্ণনায় এসেছে। 

বিখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবেত্তা আবু জাফার তাবারি এই হাদীসের সনদ ও পন্থাকে দুই খণ্ডের এক গ্রন্থে সংকলিত করেছেন।আর সে দিনই হাসসান বিন সাবিত গাদীরের ঐতিহাসিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করেন-

ینادیهم یوم الغدیر نبیهم بخم واسمع بالرسول منادیافقال فمن مولاکم و نبیکم؟ فقالوا و لـم یبدوا أهناک التعامیاإلهک مولانا و أنت نبینا و لم تلق من فی الولایة عاصیافقال له: قم یا علی فإننی رضیتک من بعدی إماما و هادیافمن کنت مولاه فهذا ولیّه فکونوا له اتباع صدق موالیاهناک دعا: اللهم وال ولیه و کن للذی عادی علیا معادیا

অনুবাদ:১ গাদীরের দিন তাদের (মুসলমানদের) নবী তাদেরকে আহ্বান জানালেন উচ্চস্বরে, (কি বিস্ময়!) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল (সা.) দেখ কিভাবে আহ্বান করছেন {কিংবা শোন এখন, যা বললেন রাসূল (সা.)}

২। অতঃপর তিনি শুধালেন জনগণকে: কে তোমাদের প্রভু (মাওলা তথা অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক) ও নবী? সেখানকার সবাই বললো নির্দ্বিধায়:

৩। আপনার আল্লাহ আমাদের অভিভাবক এবং আপনি আমাদের রাসূল। আজ আপনি আমাদের মাঝে কোনো অবাধ্যকেই খুঁজে পাবেন না।

৪। অতঃপর বললেন: হে আলী ওঠ! নিশ্চয়ই আমি এতে সন্তুষ্ট যে আমার পর তুমিই ইমাম (নেতা) ও হেদায়াতকারী।

৫। অতএব, আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা। তোমরা তাঁর প্রকৃত বন্ধু হও বা তাঁকে ভালবাস ও তাঁর অনুসারী হও।

৬। এরপর তিনি সেখানে দোয়া করলেন: হে আল্লাহ্! আলীর বন্ধুকে তোমার বন্ধু মনে কর এবং যে আলীর সাথে শত্রুতা করবে তুমিও তার সাথে শত্রুতা কর।

গাদিরে খুমের ওই ঘটনার ২৫ বছর পর তৃতীয় খলিফা নিহত হলে মুসলমানদের ব্যাপক অনুরোধ ও পীড়াপীড়ির মুখে আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.) এখন থেকে ১৪০২ বছর আগে ঠিক আজকের দিনটিতে (১৮ ই জ্বিলহজ্ব) একান্ত অনীহা ও অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুসলমানদের রাজনৈতিক নেতা বা খলিফা হন। সামাজিক ন্যায়বিচার-ভিত্তিক আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা হিসেবে প্রায় ৫ বছর শাসন করার পর এক ধর্মান্ধ খারেজির সন্ত্রাসী হামলায় আহত হয়ে (একুশে রমজান) তিনি শহীদ হন। হামলার সময় তিনি কুফার মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করছিলেন। আর তাঁর জন্ম হয়েছিল পবিত্র কাবা ঘরে।

সাহাবিদের মধ্যে আলী (আ.)’র অনন্য এবং শ্রেষ্ঠ মর্যাদার কিছু যুক্তি ও  দলিল-প্রমাণ:  

রাসূল (সা.) বিভিন্ন সময়ে বলেছেন:

" আলী আমার থেকে এবং আমি তাঁর থেকে এবং আলীই আমার পর সমস্ত মুমিনদের ওলি তথা অভিভাববক ও নেতা" (তিরমিজি, ৫ম খণ্ড, পৃ-১১০)

রাসূল (সা.) আরো বলে গেছেন, আলী সব সময়ই হকের পথে থাকবে। “আলী (আ.)-কে মহব্বত করা ঈমান, আর আলী(আ.)’র সঙ্গে শত্রুতা করা মুনাফেকী” (মুসলিম, ১ম খণ্ড, পৃ-৪৮)।“আমি জ্ঞানের শহর, আলী তার দরজা”(সহি তিরমিজি, ৫ম খণ্ড, পৃ;২০১)। এমনকি রাসূল (সা.) এ দোয়াও করেছেন যে, “হে আল্লাহ সত্যকে আলীর পক্ষে ঘুরিয়ে দিও।”  রাসূল (সা.) আরো বলেছেন, কেবল মুনাফিকই আলীর সঙ্গে শত্রুতা করবে। 

 

“যে আলীকে দোষারোপ করল, সে আমাকে দোষারোপ করল, আর যে আমাকে দোষারোপ করল সে খোদাকে দোষারোপ করল। আল্লাহ তাকে মুখ নিচু করে দোজখে নিক্ষেপ করবেন।”(সহি বুখারী-দ্বিতীয় খণ্ড, সহি মুসলিম- দ্বিতীয় খণ্ড, সহি তিরমিজি, ৫ম খণ্ড)। 

“আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা। হে খোদা যে আলীর সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখে তুমিও তার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখ, যে আলীর সাথে শত্রুতা রাখে তুমিও তার সাথে শত্রুতা রাখ।” (সহি মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ-৩৬২, মুসনাদে ইমাম হাম্বল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ-২৮১) 

সাহাবিদের অনেকেই বলতেন, আমরা আলীর সঙ্গে বন্ধুত্ব ও শত্রুতা দেখে কে মুনাফিক ও কে মুমিন তা নির্ধারণ করতাম।

রাসূল (সা.) আরো বলেছেন: “এই আলী আমার ভাই, আমার ওয়াসি এবং আমার পর আমার প্রতিনিধি হবে। তাই তাঁর আদেশ শোন, তাঁর আদেশ মত কাজ কর।” (তাফসিরে তাবারি, ১৯ খণ্ড, পৃ-১২১, ‘লাইফ অফ মুহাম্মাদ’-ড. মো. হোসাইন হায়কাল, প্রথম সংস্করণ১৩৫৪ হি,প্রথম খণ্ড, পৃ-১০৪)

হযরত আহমদ বিন হাম্বল বলেছেন, “যত ফজিলতের বর্ণনা আলীর বেলায় এসেছে অন্য কোনো সাহাবির বেলায় তা আসেনি। আলী (আ.)’র অসংখ্য শত্রু ছিল। শত্রুরা অনেক অনুসন্ধান করেছে আলী (আ.)’র দোষ-ত্রুটি বের করার, কিন্তু পারেনি।”

হযরত কাজী ইসমাইল নাসায়ি আবু আল নিশাবুরি বলেন, “যত সুন্দর ও মজবুত সনদের মাধ্যমে আলী (আ.)’র ফজিলতগুলো বর্ণিত হয়েছে-অন্য সাহাবিদের বেলায় তেমনি আসেনি।”

হযরত আলী সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, আলী প্রেম মানুষের পাপ এমনভাবে ধ্বংস করে যেমনি আগুন জ্বালানী কাঠ ধ্বংস করে দেয়। একবার হযরত আলী (আ.)-কে দেখে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছিলেন, তিনটি এমন বৈশিষ্ট্য তোমার রয়েছে যেটা আমারও নেই, এই তিনটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তুমি এমন একজনকে শ্বশুর হিসেবে পেয়েছে, যা আমি পাইনি, এমন একজনকে তুমি স্ত্রী হিসেবে পেয়েছে, যে কিনা আমার কন্যা, আর তৃতীয়টি হচ্ছে তুমি হাসান- হুসাইনের মত সন্তানের পিতা যেটা আমার নেই। 

রাসূলে খোদা (সা.) এর আগেও বহুবার আলী (আ.)-র বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের কথা ঘোষণা করেছেন। ইবনে আব্বাসসহ আরো অনেকের বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসূলের পরে আলী (আ.)-ই ছিলেন সবচেয়ে মোত্তাকি ও সাহসী ব্যক্তি।

একবার বিশ্বনবী (সা.) কয়েকজন সাহাবির সঙ্গে ঘরে বসেছিলেন। সেখানে একটি বিশেষ পাখীর মাংস খাবার হিসেবে আনা হয়েছিল। রাসূল (সা.) বললেন, হে আল্লাহ তোমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। এমন সময় দরজায় টোকা দিলেন আলী (আ.)। রাসূল (সা.) আলী (আ.)-কে নিয়ে সেই মাংস খান।

জাবের বিন আব্দুল্লাহ আনসারি বলেছেন, একবার রাসূল (সা.)-র কাছে আলী (আ.) এলেন। রাসূল বললেন, আলী (আ.) ও তার অনুসারীরা কিয়ামতে পরিত্রাণপ্রাপ্ত। এ সময় সূরা বাইয়ানার ৭ নম্বর আয়াত নাজিল হয়। সেখানে বলা হয়েছে, যারা ঈমান এনেছে এবং সত কাজ করেছে, তারা আল্লাহর সর্বোত্তম সৃষ্টি। এরপর থেকে রাসূলের সাহাবিরা আলী (আ.)-কে দেখলেই বলতেন, ওই যে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।

হযরত আলী (আ.) ছিলেন জ্ঞান, বীরত্ব, সাহস, দূরদর্শিতা, মহানুভবতা, দয়া, পরোপকার, ন্যায়নিষ্ঠা ইত্যাদি গুণের আকরসহ মানবীয় মূল্যবোধ ও যোগ্যতার সব দিক থেকে একজন ভারসাম্যপূর্ণ ও পরিপূর্ণ আদর্শ মানব। বিশ্বনবী (সা.) তাঁকে প্রায় ৫/৬ বছর বয়স থেকে নিজের হাতে ও নিজের ঘরে রেখে মনের মত করে গড়ে তোলেন এবং জ্ঞানগত নানা দিকসহ সব দিকে যোগ্য উত্তরসূরি হিসেব প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

মর ইবনে খাত্তাব বলেছেন, আলী না থাকলে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত এবং আলীর মত একজন মহামানব জন্ম দেয়ার ক্ষমতা পৃথিবীর আর কোনো নারীর নেই। তিনি আলী (আ.)'র শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন হিসেবে তিনটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা শ্রেষ্ঠত্বের কথা উল্লেখ করেছেন যা আর কারো ছিল না। এ তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিল: "(নবী-নন্দিনী) ফাতিমা (সা. আ.)'র সঙ্গে তাঁর বিয়ে, মসজিদে (নববীর) ভেতরে তাঁর বসবাস অব্যাহত থাকা যা আমার জন্য বৈধ নয় এবং খায়বার যুদ্ধের পতাকা (তথা সেনাপতিত্ব) পাওয়া।"

আলী (আ.)'র আগে অন্য সেনাপতিরা মদিনায় ইহুদি শত্রুদের খায়বার দুর্গ জয় করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন,

"আগামীকাল আমি এমন একজনের হাতে পতাকা দেব যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও তাঁকে ভালবাসেন।"

গাদির দিবস: হযরত আলীকে রাসূল (সা. আ)'র স্থলাভিষিক্ত ঘোষণার দিন

বেলায়েত বা নেতৃত্বের দর্শন:

সমাজ পরিচালনার জন্য নেতৃত্ব একটি অপরিহার্য বিষয়। মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা নেয়ামত হলো- নেতৃত্বের যোগ্যতা। এই যোগ্যতা, গুণ ও ক্ষমতা সীমিত সংখ্যক লোকের মধ্যেই আল্লাহ দিয়ে থাকেন। বাকীরা তাদের অনুসরণ করেন। মানব ইতিহাসের কিছু নেতা সরাসরি আল্লাহর মাধ্যমে মনোনীত। এঁরা হলেন, নবী, রাসূল ও আহলে বাইতের ইমামগণ, যারা সরাসরি আল্লাহর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। ফলে তাদের প্রতিটি কথা, কাজ ও আচরণ সব মানুষের জন্য যথাযথভাবে অনুকরণীয়। মানব সমাজের নেতৃত্বের বিষয়টি যে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, সে বিষয়টি পবিত্র কুরানেও উল্লেখ করা হয়েছে। 

পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ১২৪ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, স্মরণ করো যখন ইবরাহীমকে তার প্রতিপালক কয়েকটি ব্যাপারে পরীক্ষা করলেন এবং সেসব পরীক্ষায় সে পুরোপুরি উত্তীর্ণ হলো। এরপর আল্লাহ বলেছিলেন "আমি তোমাকে সব মানুষের নেতার পদে অধিষ্ঠিত করবো।" ইবরাহীম আবেদন করেছিলেন- আর আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও ( ইমাম বা নেতা করুন)। আল্লাহ জবাব দিলেন: "আমার এ অঙ্গীকার জালেমদের ব্যাপারে প্রযোজ্য হবে না (কেবলমাত্র তোমার যেসব বংশধর নিষ্পাপ ও পবিত্র থাকবে,তারাই এ পদের যোগ্য হিসেবে গণ্য হবে)। 

হজরত মূসা(আ.) তাঁর ভাই হারুনকে নিজের সহযোগী ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করার জন্য আল্লাহর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এরপর আল্লাহ তা কবুল করেন। সূরা ত্বাহার ৩৬ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে: আল্লাহ বললেন, "হে মূসা! তুমি যা চেয়েছো তা তোমাকে দেয়া হলো।' 

সূরা সা'দের ২৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা, হজরত দাউদ (আ.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, 'হে দাউদ ! আমি অবশ্যই তোমাকে পৃথিবীতে সৃষ্টিকুলের প্রতিনিধি করেছি। সুতরাং মানুষের মধ্যে সত্য ও [ ন্যায়ের ] ভিত্তিতে বিচার -মীমাংসা কর।'

এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা এ কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে,তিনিই মানব জাতির নেতা ও ইমাম নির্ধারণ করেন। ইসলাম ধর্মে নেতৃত্ব ও ইমামত কেবল মানুষের দৈনন্দিন ও প্রচলিত জীবন ব্যবস্থার জন্য নয়। ইসলাম ধর্মে একজন ইমাম বা নেতা, বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক-উভয় ক্ষেত্রের নেতা। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ি বলেছেন, ইসলাম ধর্মে একজন নেতা, জনগণ থেকে আলাদা নয়। গাদিরের ঘটনাকে তিনি জনগণের নেতৃত্ব ও নীতির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হিসেবে গণ্য করেন। 

রাসূল (সা.)-র ওফাতের পর শান্ত মুসলিম সমাজ যাতে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে না পড়ে এবং স্বার্থান্বেষীরা ওই শোকাবহ ঘটনাকে যাতে অপব্যবহার করতে না পারে সেজন্য রাসূল (সা.)-কে এ দায়িত্ব দেয়া হয় যে, তিনি যাতে তাঁর পরবর্তী নেতার নাম ঘোষণা করেন।  রাসূলে খোদা বিদায় হজ্বের পর এক সমাবেশে  আলী(আ.)কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করেন। তিনি আলী (আ.)-এর যোগ্যতা বর্ণনা করতে যেয়ে বলেন,

“হে জনগণ, এমন কোনো জ্ঞান নেই, যা আল্লাহ আমাকে দেননি এবং আমিও পরহেজগারদের নেতা আলী (আ.)-কে সেই জ্ঞান শিখিয়েছি। আপনারা কেউই আলী (আ.)-র পথ থেকে বিচ্যুত হবেন না। তাঁর পথ থেকে দূরে সরে যাবেন না। তাঁর নেতৃত্বকে অমান্য করবেন না। কারণ সে সবাইকে সত্যের পথে পরিচালিত করে এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে কাজ করে। সে অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটায় এবং নিজে অন্যায় থেকে দূরে থাকে। আলী (আ.) আল্লাহর পথে চলার ক্ষেত্রে কোনো কিছুকেই ভয় করে না। 

আলী (আ.) হচ্ছে প্রথম মুসলমান। রাসূলে খোদার জন্য সে তাঁর প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত রয়েছে। সে সর্বদা রাসূলের পাশে ছিল ও আছে এবং আর কেউই তাঁর মতো রাসূলের নির্দেশ মেনে চলার ক্ষেত্রে এতো বেশি আন্তরিক নয়।

হে মুসলমানগণ, আলী (আ.) হচ্ছে আমার ভাই, স্থলাভিষিক্ত ও আমার শিক্ষায় শিক্ষিত। সে আমার উম্মতের নেতা-কোরানের তাফসির যার জানা। সে কুরআনের দিকে আহ্বানকারী এবং কুরআনের নির্দেশ বাস্তবায়নকারী। সে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে। সে আল্লাহর শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। সে আল্লাহ বিরোধীদের শত্রু এবং আল্লাহপ্রেমীদের বন্ধু। সে আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে জনগণকে বিরত রাখে।”

মানুষের ওপর তিনিই নেতৃত্ব দেয়ার সবচেয়ে বেশি যোগ্য যিনি সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী। আর বিশ্বনবী (সা.)’র পর তাঁর পবিত্র হাদিস অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী ছিলেন আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)। কারণ, হাদিসে এসেছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, আমি জ্ঞানের নগর আর আলী হল তার দরজা। অর্থাত বিশ্বনবী (সা.)’র জ্ঞানের শহরে প্রবেশের জন্য আলী (আ.) নামক মাধ্যম বা দরজা দিয়েই ঢুকতে হবে। 

এ ছাড়াও হাদিসে বলা হয়েছে, “আল ওলামাউ ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া।” অর্থাত নবীগণের উত্তরসূরি হচ্ছেন আলেমগণ। হযরত আলী (আ.) যে বিশ্বনবী (সা.)’র পর শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন তাতে তাঁর শত্রু -মিত্র নির্বিশেষে কোনো সাহাবিই সন্দেহ পোষণ করতেন না। এ কারণেই মহান আল্লাহর নির্দেশে বিশ্বনবী (সা.) আলী (আ.)-কে তাঁর উত্তরসূরি বা স্থলাভিষিক্ত তথা মুসলমানদের ইমাম বা নেতা বলে ঘোষণা করেছিলেন পবিত্র গাদীর দিবসে। এই ইমামত হচ্ছে নবুওতেরই ধারাবাহিকতা। 

ইসলামে ঐশী ইমামত বা খোদায়ী নেতৃত্ব ঠিক করে দেন মহান আল্লাহ। আর সেটা বংশ পরম্পরায়ও চলতে পারে। যেমন, নবী হয়েছিলেন ইব্রাহিম (আ.)'র বংশধরগণ এবং হযরত দাউদ (আ.)'র পুত্র সুলায়মান ও হযরত মুসা (আ.)'র ভাই হারুন (আ.)।

ইমামত বা নবুওতের মত ঐশী বা খোদায়ী পদগুলোতে কারা আসীন হবেন মানুষ তা ঠিক করার অধিকার রাখে না। কারণ, মানুষের মনোনয়ন বা নির্বাচন ভুলও হতে পারে। তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই তা ঠিক করে দেন। বিশ্বনবী (সা.) বিভিন্ন সময় আলী(আ.) কে নিজ খলিফা হিসেবে নিযুক্ত করার কথা ঘোষণা করেছেন। এরমধ্যে তিনটি দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করছি:

প্রথমত: রাসূল হিসেবে মনোনীত হওয়ার তথা বে’সাতের প্রথম দিকে: বিশ্বনবীকে (সা.) যখন নিজের আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত দেয়ার জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয় তখন তিনি সবার উদ্দেশে বললেন:“যে ব্যক্তি এই পথে আমাকে সাহায্য করবে, সেই হবে আমার ওয়াসি তথা কর্তৃত্বের অধিকারী, উজির বা পৃষ্ঠপোষক এবং স্থলাভিষিক্ত ।” রাসূল (স.) এভাবে বলেন-

“তোমাদের মাঝে কে এমন আছে যে এই কাজে আমাকে সহযোগিতা করবে যাতে সে তোমাদের মাঝে আমার ভাই, উজির (পৃষ্ঠপোষক), খলিফা এবং স্থলাভিষিক্ত হতে পারে?” 

কেবল আবু তালিবের সন্তান আলী (আ.) রাসূল (স.) এর কথায় হ্যাঁ সূচক উত্তর দেন।আর তখন আল্লাহর রাসূল (স.) নিজ আত্মীয় স্বজনদের উদ্দেশে বলেন-“এই (আলী) তোমাদের মাঝে আমার ভাই, ওয়াসি এবং খলিফা। অতএব, তোমরা তার কথা শোন এবং তাকে অনুসরণ কর।”

দ্বিতীয়ত: তাবুকের যুদ্ধে: রাসূলুল্লাহ (স.) আলী (আ.) এর উদ্দেশে বলেন-

“[হে আলী!] তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তুমি আমার কাছে ঠিক তদ্রূপ যেমন হারুন (আ.) ছিলেন মুসা (আ.) এর কাছে। তবে পার্থক্য এই যে, আমার পরে আর কোনা নবী নেই (আসবে না)।’

অর্থাৎ যেভাবে হারুন (আ.) কোনরকম ব্যবধান ছাড়াই মুসা (আ.) এর স্থলাভিষিক্ত ছিলেন তুমিও আমার খলিফা ও স্থলাভিষিক্ত।

তৃতীয়ত: দশম হিজরিতে: বিদায় হজ থেকে ফেরার পথে ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে হাজিদের এক বিশাল সমাবেশে মহানবী (স.) আলী (আ.) কে মুসলমান ও মু’মিনদের নেতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। 

তিনি বলেন-

“আমি যার মাওলা (অভিভাবক) আলীও তার মাওলা।” এই বাক্যটি তিনি তিনবার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। এরপর বললেন:- “হে আল্লাহ! তাকে তুমি ভালবাসত যে আলীকে ভালবাসে ও তুমি তার প্রতি শত্রুতা পোষণ কর যে আলীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করে; তুমি সহযোগিতা কর তাকে যে আলীকে সহযোগিতা করে, তুমি তাকে নিঃসঙ্গ কর যে আলীকে একা রাখে এবং সত্যকে আলীর সাথে রাখ তা যে দিকেই থাক না কেন”।

হে লোকসকল! আপনারা অবশ্যই যারা উপস্থিত আছেন তারা এই বাণীটি অনুপস্থিতদের নিকট পৌঁছিয়ে দিবেন। রাসূলের (সা.) বক্তব্য শেষ হলে জিবরাঈল (আ.) আবার দ্বিতীয়বারের মত অবতীর্ণ হয়ে তাঁকে এই বাণীটি পৌঁছে দেন:

আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম ও আমার নেয়ামত বা অবদানকে তোমাদের উপর সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়িদা-৩)

রাসূল (সা.) এই বাণী পেয়ে মহা-আনন্দিত হলেন এবং বললেন- মহান আল্লাহর শুকর করছি যে তিনি দ্বীনকে পরিপূর্ণ ও তাঁর নেয়ামতকে সম্পূর্ণ করেছেন এবং মহান প্রভু আমার রেসালাতের বা নবুওতি দায়িত্বের ও আলীর বেলায়াতের বা অভিভাবকত্বের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- আল্লাহর রাসূল (স.) তাঁর বক্তব্যের শুরুতে বলেছিলেন: “আমি কি তোমাদের ওপর তোমাদের নিজেদের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব রাখি না?” তখন উপস্থিত সব মুসলমান দাঁড়িয়ে রাসূল (স.) এর এ কথার প্রতি সম্মতি জানান। অতএব, বিষয়টি হতে স্পষ্ট হয় যে, এই হাদিসে 'মাওলা' বলতে মু’মিনদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব ও তাদের পূর্ণ কর্তৃত্বকে বোঝানো হয়েছে। অতএব, এটা স্পষ্ট যে, আল্লাহর রাসূল (স.) যে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ছিলেন উম্মতের ক্ষেত্রে তা তিনি আলী(আ.) এর জন্যও নিশ্চিত করে যান।  পার্সটুডে

captcha