IQNA

ইয়াজুজ-মাজুজের প্রাচীর কোথায়

0:01 - September 25, 2022
সংবাদ: 3472527
তেহরান (ইকনা): মুসলিমমাত্রই জানে যে ইয়াজুজ-মাজুজ একটি বর্বর জাতি, যাদের অনিষ্ট থেকে সভ্য মানুষদের রক্ষার্থে জুলকারনাইন বাদশাহ শক্ত প্রাচীর তুলে দিয়েছিলেন।
কিন্তু অনেকেরই প্রশ্ন যে, তারা এবং তাদেরকে ঘেরাওকৃত প্রাচীরটি কোথায় অবস্থিত? এর জবাবের প্রথমেই জেনে নেই এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে কী এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অবশেষে যখন সে (বাদশাহ জুলকারনাইন) পথ চলতে চলতে দুই পর্বতের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে পৌঁছল, সেখানে এমন এক জাতিকে পেল, যারা তার কথা সুস্পষ্ট বুঝতে পারছিল না। 
তারা বলল, ‘হে জুলকারনাইন! নিশ্চয় ইয়াজুজ ও মাজুজ জমিনে অশান্তি সৃষ্টি করছে, তাই আমরা কি আপনাকে কিছু খরচ দেব, যাতে আপনি আমাদের ও তাদের মাঝে একটা প্রাচীর নির্মাণ করে দেবেন?’ সে বলল, ‘আমার রব আমাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন, সেটাই উত্তম।
 
 
অতএব তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য করো। আমি তোমাদের ও তাদের মাঝখানে একটি সুদৃঢ় প্রাচীর নির্মাণ করে দেব। ’ ‘তোমরা আমাকে লোহার পাত এনে দাও। ’ অবশেষে যখন সে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী জায়গা সমান করে দিল, তখন সে বলল, ‘তোমরা ফুঁক দিতে থাকো। ’ অতঃপর যখন সে তা আগুনে পরিণত করল, তখন বলল, ‘তোমরা আমাকে কিছু তামা দাও, আমি তা এর ওপর ঢেলে দিই। ’ এরপর তারা প্রাচীরের ওপর দিয়ে অতিক্রম করতে পারল না এবং নিচ দিয়েও তা ভেদ করতে পারল না। সে বলল, ‘এটা আমার রবের অনুগ্রহ। অতঃপর যখন আমার রবের ওয়াদাকৃত সময় আসবে তখন তিনি তা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবেন। আর আমার রবের ওয়াদা সত্য। ’ (সুরা : কাহফ, আয়াত :  ৯৩-৯৮)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশেষে যখন ইয়াজুজ ও মাজুজকে মুক্তি দেওয়া হবে, আর তারা প্রতিটি উঁচু ভূমি হতে ছুটে আসবে। ’
 
(সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৯৬)
 
ইয়াজুজ-মাজুজের অবস্থানস্থলবিষয়ক মতামত
 
কোরআন-হাদিসে ইয়াজুজ-মাজুজের সুনির্দিষ্ট অবস্থান সুস্পষ্টরূপে বলা হয়নি। যদিও কোরআনে কারিমের ইঙ্গিতে তা পৃথিবীর উত্তরাঞ্চলে হওয়া বোঝা যায়। আর যেহেতু কোরআনের মৌলিক নির্দেশনা বোঝার জন্য তাদের সুনির্দিষ্ট অবস্থান জানা জরুরি নয় এবং মানবজাতির প্রভূত কল্যাণ তা জানার ওপর নির্ভরশীল নয়, তাই সুনির্দিষ্টভাবে তা না জানলেও কোনো অসুবিধা নেই, বরং এ ব্যাপারে আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর কথার ওপর সামগ্রিক বিশ্বাসই যথেষ্ট। তবে স্বাভাবিকভাবে তা জানার কৌতূহল সবার অন্তরেই জাগ্রত হয় বিধায় অনেক তাফসিরবিদ, ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদ তা উদ্ঘাটনের জন্য চেষ্টা ও গবেষণা করেছেন। কিন্তু অবশেষে নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি বিধায় এ বিষয়ে মতানৈক্য থেকেই গেছে। অনেক তাফসিরবিদ যথা—তাবারি ও কুরতুবি প্রমুখ বর্ণনা করেন যে, তাঁরা তুর্কিদের অন্তর্ভুক্ত একটি জাতি, যাদের অবস্থানস্থল হলো আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের কাছাকাছি অঞ্চলে। কেউ কেউ বলেন, তাদের অবস্থানস্থল হলো চীনের উত্তরে। আবার কেউ বলেন, ককেশাস পর্বতমালার আশপাশে কোথাও অবস্থিত। (তাফসিরে কুরতুবি ১১/৫৬)
 
তৃতীয় হিজরি শতাব্দীর প্রখ্যাত ভূগোলবিদ ইবনে খরদিজবাহ (মৃত্যু : ২৮০ হি.) স্বীয় কিতাবে আব্বাসি খলিফা ওয়াসিক বিল্লাহের নির্দেশে দোভাষী ‘সাল্লাম’-এর নেতৃত্বে একদল লোককে ইয়াজুজ-মাজুজের খবর সংগ্রহের জন্য অভিযানে প্রেরণের ঘটনা বর্ণনা করেন। তারা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে প্রায় আড়াই বছর পর ফিরে এসে পৃথিবীর উত্তর-পূর্ব ভূখণ্ডে ইয়াজুজ-মাজুজের অবস্থান সম্বন্ধে জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। ইবনে কাসির (রহ.)-সহ অনেক ইতিহাসবিদই এটি ইবনে খরদিজবাহর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। (আলমাসালেক ওয়াল মামালেক, পৃষ্ঠা ১৬২-১৬৪, আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া ৭/১৪১-১৪২)
 
আল্লামা হিফজুর রহমান সিউহারবি (রহ.) লেখেন যে ইয়াজুজ-মাজুজের দৌরাত্ম্য বিশাল ভূখণ্ডব্যাপী বিস্তৃত ছিল। তাই যুগে যুগে বিভিন্ন অংশে কয়েকটি রক্ষাপ্রাচীরই নির্মাণের কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। যেমন—চীনের মহাপ্রাচীর, যা চীনের জনৈক রাজা তৈরি করেছেন। দাগিস্তানে অবস্থিত আরেকটি প্রাচীর রয়েছে। আরেকটি প্রাচীর ককেশাস পর্বতমালার উচ্চভূমিতে অবস্থিত। উক্ত প্রাচীরগুলোর শেষ দুটির ব্যাপারে অনেকের ধারণা যে এর কোনো একটি জুলকারনাইনের তৈরীকৃত প্রাচীর হতে পারে। (কাসাসুল কুরআন : ২/১৫১-১৫৩)
 
ইয়াজুজ-মাজুজের প্রাচীরটি কি ধ্বংস হয়ে গেছে?
 
কেউ কেউ বলেন, জুলকারনাইনের তৈরীকৃত প্রাচীরটি ধ্বংস হয়ে গেছে, আর মোঙ্গলীয় তাতারিরাই হলো ইয়াজুজ-মাজুজ। কেউ কেউ রুশদেরকেও তাদের গোত্রীয় বলে মত ব্যক্ত করেন। কিন্তু এসব মতামত কোরআন-হাদিসের বর্ণনার বিপরীত মনে হয়, কেননা ইয়াজুজ-মাজুজের দলবদ্ধ আত্মপ্রকাশ শেষ যুগে কিয়ামতের পূর্বমুহূর্তে হওয়ার কথা হাদিসে এসেছে। (দেখুন—সহিহ মুসলিম : হাদিস ২৯৩৭)
 
তবে এভাবে ব্যাখ্যা করলে তা মানা যায় যে, তাতারি ও রুশ-চায়নিজরা হয়তো ইয়াজুজ-মাজুজ জাতির একটি অংশ, যে অংশটা ধীরে ধীরে সভ্য পৃথিবীর সঙ্গে মিশে সভ্য হয়েছে, তবে তাদের গোত্রীয় বেশির ভাগ অসভ্য রয়ে গেছে, যাদের চূড়ান্ত আবির্ভাব কিয়ামতের আগে হবে।
 
কিন্তু প্রশ্ন হলো, জুলকারনাইনের প্রাচীরটি যদি অস্তিত্বশীল থাকে তাহলে তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে যখন দুনিয়া হাতের মুঠোয়, আমরা তার সন্ধান পাই না কেন? এর জবাবে ওলামায়ে কেরাম লেখেন যে, কারো খুঁজে না পাওয়া অস্তিত্বে না থাকার প্রমাণ নয়। কেননা এই আধুনিক যুগেও এখনো বিভিন্ন পাহাড়ি ভূখণ্ডে বা সামুদ্রিক দ্বীপাঞ্চল থেকে নিত্যনতুন এলাকা ও মানবগোত্রের আবিষ্কার হয়, যার খবর পৃথিবী এত দিন জানতই না। তাই হয়তো বা জুলকারনাইনের প্রাচীরটি কোনো পর্বতমালার নিচে মাটিচাপা পড়ে গেছে, অথবা তাদের ভূখণ্ড বিশাল কোনো জলরাশি বা বরফাঞ্চলের আড়ালে হওয়ায় আমরা খবর পাচ্ছি না। কিয়ামতের আগে আল্লাহর নির্ধারিত সময়ে তাদের আবির্ভাব হবে। এটি অসম্ভব কিছু নয়। (তাফসিরে রুহুল মাআনি : ৮/৩৫৯, মাআরেফুল কোরআন : ৫/৬৫৩)
captcha