বার্তা সংস্থা ইকনা: তিনি ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু, সাদা-কালো সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন। মানুষের কল্যাণে তিনি নিরলসভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।শিশুদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল স্নেহপূর্ণ, কোমল এবং বন্ধুসূলভ। তিনি তাদের হাসি আনন্দে যোগ দিতেন। ছোটদের চপলতায় তিনি কখনও অসন্তষ্ট কিংবা বিরক্ত হতেন না। রাসূল (সা.) তাদের সাথে সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন। শিশুরা তাঁর কাছে এলে নিজেদের সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যেত।
শিশুদের প্রতি মহানবী (সা.)'র স্নেহ ও পিতৃসূলভ আচরণের কথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। রাসূল (সা.) শিশুদের সাথে খেলতেন এবং এমনকি তাদের খেলনা ও পোষা প্রাণীরও খবর নিতেন। তিনি তাঁদের সাথে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে ও নীচু কণ্ঠে কথা বলতেন। বিশেষ করে নাতি ইমাম হাসান ও হোসাইনের প্রতি রাসূলের ভালোবাসা ও স্নেহের কথা কমবেশী সবাই জানে। মহানবী (সা.) তাঁর এ নাতিদের সাথে খেলাধুলা করতেন এবং অন্যদের সামনে তাদের চুমু দিতেন।
ফ্রান্সের বিখ্যাত মনীষী সিদুয়া বলেছেন, "শিশুদের প্রতি তাঁর ছিল ব্যাপক অনুগ্রহ। তিনি তাদের প্রশান্তি চিন্তা করতেন সবসময়। বিশেষ করে ইয়াতিম শিশুদের নিয়ে সারাক্ষণ ভাবতেন তিনি। শিশুদের আদর-স্নেহ করতে ভালবাসতেন। মুহাম্মাদ কন্যাশিশুদের জীবিত কবর দেয়াকে সম্পূর্ণ হারাম বলে ঘোষণা দেন। পিতা-মাতা এবং শিশুদের ভালোবাসার ব্যাপারে নবীজীর বক্তব্য কতো সুন্দর এবং অমায়িক।"
একদিন প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) খেতে বসেছিলেন। কিন্তু খানা তখনও শুরু করেননি। উম্মে কায়েস বিনতে মুহসিন (রা.) তার শিশুপুত্রটিকে কোলে করে রাসূলের সাথে দেখা করতে আসলেন। শিশুটিকে দেখে রাসূল (সা.) তার দিকে এগিয়ে এলেন। পরম আদরে কোলে তুলে নিয়ে খাবারের জায়গায় গিয়ে বসলেন। শিশুটি নবীজীর আদর পেয়ে তাঁর কোলেই পেশাব করে ভিজিয়ে দিল। রাসূল (সা.) মুচকি হাসলেন। তাঁল চেহারায় বিরক্তি প্রকাশ পেল না। তিনি পানি আনার জন্য একজনকে বললেন। পানি আনা হলে যে যে জায়গায় পেশাব পড়েছিল সেখানে পানি ঢেলে দিলেন। রাসূলেখোদা মনে করতেন, বাগানের ফুল যেমন পবিত্র, মায়েব কোল থেকে নেয়া শিশুও তেমনি পবিত্র।
নিজের সন্তানদের ওপর নবীজীর ব্যাপক ভালোবাসা ও মায়া-মমতা ছিল। এমনিতেও তিনি শিশুদের প্রতি ছিলেন সদয়। শিশুদের মনে আনন্দ দেয়ার জন্যে তাদের সাথে খেলতেন। হযরত জাবের বলেন, একদিন দেখলাম হাসান এবং হুসাইন নবীজীর পিঠে চড়ে বসেছে। নবীজী হাত-পা চালিয়ে এগুচ্ছেন আর বলছেন, ভালো বাহন পেয়েছো, তোমরাও খুব ভালো চালক। কিন্তু যখন এ আয়াত নাযিল হলো ' নিজেদেরকে যেভাবে তোমরা ডাকো, নবীজীকে সেভাবে ডেকো না অর্থাৎ সম্বোধন করো না।' নবীজীর আগমন ঘটায় ফাতেমা (সা.) সামনে এসে বললেন 'হে আল্লাহর রাসূল! তোমার প্রতি সালাম! রাসূল (সা.) তাঁর প্রিয়কন্যা ফাতেমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন এবং বললেন, ' না মেয়ে! তুমি আমাকে বাবা বলো। এই ডাক আমার খুবই প্রিয়।'
নবীজী একদিন এক শিশুকে হাঁটুর ওপর বসিয়ে আদর করতে করতে বলছিলেন-"শিশুদের ঘ্রাণটা বেহেশতি। তোমাদের সন্তানদের বেশি বেশি চুমু দেবে, তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমার জন্যে বেহেশতে উত্তম একটি স্থান দান করবেন।"
এমন সময় জাহেলি সমাজের একজন অভিজাত ব্যক্তি রাসূলের কাছে এলো । শিশুদের প্রতি রাসূলে খোদার স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার প্রকাশ দেখে বিস্মিত হয়ে গেল! সে বলল- "আমার দশটা ছেলে আছে। এখন পর্যন্ত তাদের কাউকেই একটিবারও আমি চুমু দেই নাই।"
এ কথা শুনে নবীজীর চেহারার রঙ পরিবর্তন হয়ে গেল। বিরক্তির সাথে তিনি বললেন, "অপরের জন্যে যার কোনো দয়ামায়া নেই, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনও তার জন্যে সদয় হবেন না। আমি কী করতে পারি, আল্লাহ তোমার অন্তর থেকে দয়ামায়া তুলে নিয়েছেন।"
কোনো এক ঈদের নামায পড়ার জন্যে নবীজী ঘর থেকে বের হলেন। রাস্তায় কয়েকটি শিশু আনন্দের সাথে খেলাধুলায় মত্ত ছিল। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি পড়লো দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো জামা-কাপড় পরা কান্নারত একটি শিশুর ওপর। নবীজীর অন্তরটা কেঁদে উঠল। তিনি সদয় হৃদয়ে শিশুটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,"তুমি কেন ওদের সাথে খেলছ না?" আক্রোশের সাথে ছেলেটি বলল, "আমার বাবা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তাই আমি যেহেতু অন্য বাচ্চাদের মতো নই সেহেতু আমি তো তাদের কাতারে মিশতে পারব না।"
নবীজী তার হাতটা ধরে অত্যন্ত দয়ার্দ্র কণ্ঠে বললেন, "আচ্ছা, আমি যদি তোমার বাবা হই আর আমার মেয়ে ফাতেমা যদি তোমার বোন হয় তুমি কি সন্তুষ্ট হবে?" শিশুটি সেই মুহূর্তে নবীজীকে চিনতে পারল। সে ভীষণ খুশি হয়ে গেল। অনেক অনেক আশা এবং বিশ্বাস তার বুকে আসন গেড়ে বসল। ঠোঁটে-মুখে তার হাসির রেখা ফুটে উঠল।
নবীজী শিশুটিকে ঘরে নিয়ে গিয়ে নতুন জামা পরালেন, খেতে দিলেন এবং ইয়াতিম চিন্তাটি তার মন থেকে মুছে দিলেন। শিশুটি এবার প্রশান্ত হৃদয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে শিশুদের সাথে খেলতে শুরু করে দিল।
শিশুদের কচিমনের প্রতি নবীজী ছিলেন ভীষণ মনোযোগী। তিনি শিশুদের ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার জন্যে তাদের সামনে গিয়ে সালাম করতেন এবং তাদের ভুলগুলো পরিহার করতেন। এ সম্পর্কেই এবারে একটি গান শোনা যাক।
ছোটদের প্রতি রাসূলেখোদার আচরণ কেমন ছিল সে সম্পর্কে গানটি শুনলে। নবীজী জানতেন যে, শিশুদের পৃথিবীটা হাসি-আনন্দ আর খেলাধূলাপূর্ণ। তাই তিনি যতোক্ষণ শিশুদের সান্নিধ্যে কাটাতেন, ততক্ষণ তাদের সাথে শিশুসুলভ অর্থাৎ তাদের মতোই আচরণ করতেন। শিশুদের সাথে শিশুদের ভাষায় কথা বলতেন। রাস্তায় যখন শিশুরা আবদার করত তাদের খেলা দেখার জন্যে রাসূল তখন তাদের খুশির জন্যে কিছুটা সময় দিতেন।
শিশুদের সাথে নবীজীর আচরণের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন বহু চিন্তাবিদ। এমিল ডরমিংহাম নামের ফরাসি এক মধ্যপ্রাচ্যবিদ রাসূলে খোদার ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন- "মুহাম্মাদ শিশুদেরকে ভালোবাসতেন। তাঁর দুই নাতি হাসান এবং হোসাইনকে নামাযের সময় তাঁর পিঠে চড়তে দিয়েছেন এবং বক্তৃতা দেয়ার সময় মিম্বারের ওপর খেলতে দিয়েছেন।"
শিশুদের অধিকার রক্ষার ওপর রাসূলে খোদা ভীষণ গুরুত্বারোপ করেছেন। শিশুর জন্যে সুন্দর একটি নাম নির্বাচন করাও তার অধিকারভুক্ত বলে তিনি উল্লেখ করেন। এক ব্যক্তি তার দুই সন্তানের মাঝে একটিকে আদর করে চুমু খেলো অপরটিকে খেলো না- এই দৃশ্য দেখে নবীজী তাকে রাগের সাথে বললেন, কেন তুমি তোমার সন্তানদের মাঝে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করছো না?
নোমান ইবনে বাশীর নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমার বাবা একদিন আমাকে একটা উপহার দিলেন, কিন্তু আমার অন্য ভাই-বোনদের কিছুই দিলেন না। এ ঘটনায় মা আমার বাবার ওপর রাগ করলেন এবং বাবাকে বললেন, আমি এই বৈষম্য পছন্দ করি না, যদি না রাসূল তোমার এই কাজকে সঠিক বলে অনুমোদন করেন। এরপর আমার বাবা নবীজীর কাছে গিয়ে বললেন, হে রাসূলে খোদা! আমি আমার সন্তানকে একটা উপহার দিয়েছি। এখন আমার স্ত্রী এ ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চেয়েছেন। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, 'তুমি কি তোমার সকল সন্তানকে উপহার দিয়েছো?' আমার বাবা বললেন, না। নবীজী বললেন-'আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমার সন্তানদের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করো। আমি কখনোই এই অন্যায় আচরণকে অনুমোদন করব না।'
শিশুদের সঙ্গে আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত তা রাসূলেখোদার জীবনী থেকে জানলাম। কিন্তু অনেক অভিভাবক আছেন যারা শিশুদের সাথে কোমল আচরণ করেন না, তাদের কথাও মনোযোগ দিয়ে শোনেন না। কেবল হু, হ্যাঁ করে যান। এমন আচরণ করলে শিশুরা কষ্ট পায়। আর এটা ইসলামী আদর্শেরও বিরোধী। মনে রাখতে হবে, ঘর সাজাতে হলে শিশু প্রয়োজন। যত মূল্যবান আসবাবপত্রের মাধ্যমেই গৃহ পূর্ণ করা হোক না কেন, একটি শিশু ঘরটিতে যত জীবন্ত, আনন্দময় এবং সুন্দর করে তোলে, অতি মূল্যবান আসবাবপত্রও তার তুলনায় মূল্যহীন। তাই আমাদের সবাইকে শিশুদের প্রতি আন্তরিক ও স্নেহশীল হতে হবে। পার্সটুডে